বিশেষ সংবাদদাতা : সারাদেশে গত বছর প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় ছিল। বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আরও কয়েক কিলোমিটার। বন্যায় তলিয়ে গিয়েছিল দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ দেশের কয়েকটি স্থানের মহাসড়ক। ভাঙাচোরা সেই সব সড়ক-মহাসড়ক অস্থায়ী মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে আরও অনেক সড়ক-মহাসড়ক ভেঙে একাকার হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এসব সড়ক মেরামতের জন্য সংশোধিত বাজেটে অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। চিঠিতে সারাদেশের সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের জন্য প্রায় তিন হাজার ২৯ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। তবে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র এক হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। বরাদ্দকৃত এই টাকায় সড়ক-মহাসড়ক কোনোভাবেই মেরামত হবে না। পাশাপাশি আগামী বর্ষায় সড়কগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাতে চরম ভোগান্তিতে পড়বে সারাদেশের মানুষ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছর ঈদুল আযহার সাত দিন আগে ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক মেরামতের নির্দেশনা জারি করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সে সময়ও এ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ছিল না। গত বছর ভাঙাচোরা সড়ক মেরামতে জন্য ৯ হাজার ১৫৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা প্রয়োজন বলে দাবি করেছিল সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তখন ওই খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই টাকাও যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যেতো তবে সড়ক-মহাসড়কের এই বেহাল দশা থাকতো না। অভিযোগ রয়েছে, গত বছর বর্ষার আগে-পরে মেরামত ও সংস্কারের নামে জোড়াতালি মার্কা কাজ হয়েছে। যে কারনে বর্ষার আগে থেকে শুরু হওয়া ভোগান্তি এখনও বিদ্যমান। মহাসড়কের বেহাল দশায় এখন প্রতিনিয়ত যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঢকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ফরিদপুর, ঢাকা-বরিশাল, ঢাকা-বগুড়া, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-কুড়িগ্রাম, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীদেরকে। মহাসড়কের স্থায়ী হয়ে যাওয়া ভোগান্তি এড়াতে যাত্রীরা ঝুঁকছে ট্রেনের দিকে। গত কয়েক মাস ধরেই চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ট্রেনের টিকেট ‘সোনার হরিণ’ হয়ে গেছে যাত্রীদের কাছে। আগে যা শুধু ঈদ মৌসুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের চিঠিতে বলা হয়েছে, গত বছর জুনে ভয়াবহ বৃষ্টিপাতের ফলে রাঙামাটিসহ তিন পাবর্ত্য জেলার মহাসড়ক পাহাড় ধসের কারণে বিধ্বস্ত হয়। পরে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে মহাসড়ক নেটওয়ার্কও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়কের কিছু অংশ তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করে যান চলাচলের উপযোগী করা হয়। এছাড়া পার্বত্য তিন জেলার সড়কগুলো মেরামতে অতিরিক্ত ২৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা চাওয়া হয়। তবে অর্থ বিভাগ চলতি অর্থবছরের বিদ্যমান বরাদ্দ থেকে এ অর্থ ব্যয়ের পরামর্শ দিয়েছে। সূত্র জানায়, পরবর্তী সময়ে বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারনে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক স্বল্পমেয়াদি মেরামতে আরও অতিরিক্ত ১৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় অর্থ বিভাগে। তবে এক্ষেত্রেও চলতি অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে এ ব্যয় নির্বাহের পরামর্শ দেয় অর্থ বিভাগ। সর্বশেষ ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি মেরামতে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৯৪৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ চাওয়া হয়। তবে অর্থ বিভাগ এ খাতে মাত্র একশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ অনুমোদন করে।
অর্থ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর বাজেটে সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল এক হাজার ৭০৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর সঙ্গে আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ায় এ খাতে এক হাজার ৮০৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা নির্ধারিত হয়ে গেছে। যদিও এ খাতে আরও এক হাজার ৯২ কোটি ৫২ লাখ টাকা প্রয়োজন। এছাড়া ঠিকাদারদের পুরনো বিল বাবদ আরও ১৩২ কোটি ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে সড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে তিন হাজার ২৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা প্রয়োজন। বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়কগুলো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে এরই মধ্যে ৭৬৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকার নতুন কর্মসূচি পিএমপি (মেজর) নিতে হয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক চিম্বুক-থানচী ৫৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, বান্দরবান-চিম্বুক ২৩ কিলোমিটার, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক ৪৮ কিলোমিটার ও দীঘিনালা-বাঘাইহাট-সাজেক সড়ক ৫১ কিলোমিটার মেরামতের জন্য দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকার চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক হাজার ৯২ কোটি ৫১ লাখ টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন। এর বাইরে সিএজি কার্যালয়ের বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের ২০১১-১২ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বকেয়া পরিশোধের জন্য চলতি অর্থবছর ১৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দরকার। এজন্য সংশোধিত বাজেটে আরও এক হাজার ২২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দের আবেদন করা হলো।
সূত্র জানায়, গত বছর বরাদ্দের টাকা থেকে সড়ক-মহাসড়কের দীর্ঘমেয়াদী তেমন কোনো কাজই হয়নি। যা হয়েছে সবই স্বল্পমেয়াদী মেরামতের কাজ। তড়িঘড়ি করে এই মেরামতের কাজ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করার কয়েকদিন পরেই সড়ক-মহাসড়ক আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। বর্ষার আগে এই ধরণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সওজের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের জবাব ছিল, মেরামত করা হয়েছিল ঠিকই। তবে তা বর্ষার পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। আর বর্ষার পর কয়েকদিনের মধ্যে সড়কগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তারা বলেন, তড়িঘড়ি করে কোনো মতে সড়কগুলো যান চলাচলের উপযোগি করা হয়েছে। আগামীতে এগুলো স্থায়ী মেরামত করা হবে।
সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর সড়ক-মহাসড়কের বেহাল দশার উপর বর্ষার আঘাতের পর বেশিরভাগ সড়ক-মহাসড়ক স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকের মতে, তারপরেও সেগুলো স্বল্পমেয়াদী মেরামত করা হয়েছে শুধুমাত্র দুর্নীতি করার জন্য। মূলত মেরামতের নামে টাকাগুলো অপচয় ও লুটপাট করা হয়েছে। সওজের একজন কর্মকর্তা বলেন, এই কয়েক মাসে সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা ক্রমে আরও অবনতি হবে। সেক্ষেত্রে চাহিদামাফিক এক হাজার ২২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা পাওয়া না গেলে সড়ক মেরামত কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে আগামী বর্ষায় সড়ক-মহাসড়কগুলো সচল রাখাও কঠিন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে যাত্রীদের ভোগান্তি গত বছরের তুলনায় অনেকাংশে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :