ডেস্ক রিপোর্ট : ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) মালিকানার পর এবার আরো একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক এস আলম গ্রুপের দখলে যাচ্ছে। আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে বেসরকারি খাতের প্রথম শ্রেণির এবি ব্যাংকের মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। নতুন মালিকানা হিসেবে এস আলম গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এর আগে জামায়াত ঘরানার ব্যক্তিরা ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন সেই নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের হাতে। এ ছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকেও কর্তৃত্ব রয়েছে এস আলম গ্রুপের। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে এস আলম গ্রুপের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে আর্থিক অবস্থার ধারাবাহিকভাবে অবনতি হচ্ছে বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের এবি ব্যাংকের। বেড়েই চলেছে খেলাপি ঋণ। দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সংকট। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে মোটা অঙ্কের টাকা প্রভিশন রাখতে গিয়ে লোকসানের খাতায় নাম লিখিয়েছে ব্যাংকটি। এই সংকট উত্তরণে এবার মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ। ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে। দফায় দফায় স্থান ও দিন পরিবর্তনের পর শেষ পর্যন্ত রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে এ সভার আয়োজন করা হয়েছে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে ব্যাংকটির উল্লেখযোগ্য শেয়ার কিনেছে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প এস আলম গ্রুপ। তারা এখন ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরিকল্পনায় রয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় এর আগে আরো দুটি ব্যাংকেও পরিবর্তন আসে। এ দুটি পরিবর্তনই ঘটে রাজধানীর দুটি পাঁচ তারকা হোটেলে আয়োজিত সভায়। যদিও প্রায় ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানায় রয়েছেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান। তার বিরুদ্ধে এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। আজ ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও বিশেষ সাধারণ সভায় (ইজিএম) অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে নতুন পরিচালক নির্বাচন করা হবে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ব্যাংকটির উল্লেখযোগ্য শেয়ার কিনেছে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি শিল্প গ্রুপ।
প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের স্থায়ী সম্পদ ও বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। অপরদিকে বেড়েছে অন্যান্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে ধার করা অর্থের পরিমাণ। খেলাপি হয়ে পড়েছে বড় অঙ্কের ঋণ। ফলে প্রভিশন রাখতে হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এদিকে ব্যাংকের প্রধান আয়ের ক্ষেত্র ঋণ বিতরণ থেকে প্রাপ্ত সুদ আয়েও নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কমে গেছে আগের বছরের তুলনায় সুদপ্রাপ্তির পরিমাণ। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি সুদ বাবদ যে পরিমাণ অর্থ আয় করছে, সুদ পরিশোধেও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ক্যাশফ্লোতে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় ব্যাংকটির ক্যাশফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা এতই অবনতি হয়েছে যে, চলতি হিসাব বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লোকসানে পড়তে হয়েছে। এ তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়ছে ১১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০১০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এমন দুরবস্থায় ব্যাংকটি আগে কখনো পড়েনি। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক বাদ দিলে গত সাত বছরে প্রতি প্রান্তিকে এবি ব্যাংক মুনাফা করেছে। অব্যবস্থাপনা, সুশাসনের অভাব, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে গত ৩ মে এবি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে এবি ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় চার হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চার হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ব্যাংকটির বিনিয়োগ কমেছে ১৪১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির সরকারি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমেছে। চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি খাতে এবি ব্যাংকের বিনিয়োগ দাঁড়ায় চার হাজার ৮১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময় ছিল চার হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর চলতি বছর অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ হয়েছে ৪৪৪ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ৪৭৬ কোটি টাকা। এবি ব্যাংকের সম্পদের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯৫ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময় ছিল ৪০৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় স্থায়ী সম্পদ কমেছে ১৩ কোটি টাকা। শুধু আগের বছরের তুলনায় নয়, চলতি বছরের প্রথমার্ধের তুলনায়ও কোম্পানিটির স্থায়ী সম্পদ কমেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির স্থায়ী সম্পদ ছিল ৪৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে স্থায়ী সম্পদ কমেছে ৬৩ কোটি টাকা।
তথ্য পর্যালোচনা করে আরো দেখা গেছে, চলতি বছর এবি ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এজেন্টের কাছ থেকে ধার করেছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময় ছিল এক হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাংকটির ধারের পরিমাণ বেড়েছে এক হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। ধারের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের জন্য প্রতিষ্ঠানটি প্রভিশন রেখেছে ৩৩৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে রাখতে হয়েছে ৩৩৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। আর শেষ তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জন্য প্রভিশন রাখতে হয়েছে ১০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ ও অগ্রিমের বিপরীতে রাখতে হয়েছে ৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এ প্রভিশন রাখার পরিমাণ আগের বছরের ৯ মাস অথবা তৃতীয় প্রান্তিক সবদিক থেকে বেশি। আগের বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন ছিল ২০৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
জানা গেছে, এবি ব্যাংকের প্রায় ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে বিএনপি সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের হাতে। তিনি এক সময় এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই পদে থাকার সুবাদে এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার অভিযোগ উঠে মোরশেদ খানের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। বিষয়টি তদন্ত করে হতবাক হয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। তারা জানায়, অফশোর ইউনিট থেকে সিঙ্গাপুরের ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেডকে ১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার (১১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা) ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। অথচ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৩ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার। ঋণের মঞ্জুরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম ডিস্ট্রিবিউশন, মিলেনিয়াম মোটরস, মিলেনিয়াম চাং ইয়ং মোটরস, মেসার্স হুন্দাই মোটরস বাংলাদেশ লিমিটেড ও মেসার্স প্যাসিফিক মোটরসকে মোটরযান ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য মূলধন হিসেবে এই ঋণ মঞ্জুর করা হয়। সব প্রতিষ্ঠানই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এসব অনিয়ম বেরিয়ে আসার পর গত ৩১ মের মধ্যে এবি ব্যাংককে অর্থ ফেরত আনার নির্দেশনা দেয় হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অর্থই ফেরত আনতে পারেনি ব্যাংকটি। এ ঘটনায় গত ১০ ডিসেম্বর ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ৪ জনকে তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই পরিস্থিতি বেশ কিছু ধরেই এবি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের গুঞ্জন ওঠে।
চার মাস আগেই এবি ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা ও বিশেষ সাধারণ সভার আয়োজন করা হয়। ভ্যানু নির্বাচন করা হয় ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরাতে। তবে অজ্ঞাত কারণে সেই সভাটি সম্পন্ন করতে পারেনি বর্তমান পর্ষদ। এরপর সিদ্ধান্ত হয় ২১ ডিসেম্বর কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে এ দুটি সভা হবে। কিন্তু শেষে এসে আবার স্থান পরিবর্তন করা হয়। সর্বশেষ গত রবিবার এজিএমের স্থান পরিবর্তন করে লা মেরিডিয়ান ঠিক করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ও বিশেষ সাধারণ সভার (ইজিএম) মাধ্যমে নতুন পরিচালক নির্বাচন করবে পর্ষদ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, পর্ষদের পরিবর্তন অনেক আগেই হওয়ার কথা ছিল। দেরি হলেও এটি ব্যাংকের জন্য ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনবে বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পর্ষদে পরিবর্তন আসতেই পারে। তা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের না। তবে নতুন পরিচালক নিয়োগ দিতে আমাদের অনাপত্তি লাগে। খেলাপি কেউ পরিচালক হচ্ছেন কি না, আরো বেশ কিছু বিষয় দেখে অনাপত্তি দেয়া হয়।
সূত্র মতে, বেশ কিছু দিন ধরেই বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। এ ছাড়া ঋণ বিতরণে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে। যাচাই-বাছাই না করেই দেয়া হচ্ছে ঋণ। বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি হচ্ছে। ফলে খেলাপি ঋণ এখন লাগামহীন। সেই সঙ্গে প্রভিশন সংরক্ষণ বা নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতিও বাড়ছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যাংকের এই আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য ২০১৬ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ইসলামী ব্যাংক এবং গত অক্টোবরে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, প্রথমত শেয়ারহোল্ডাররা পরিবর্তন করে থাকলে আপত্তি করার কিছুই নেই। কারণ শেয়ার হোল্ডাররা তা পারেই। দ্বিতীয়ত, এসআইবিএল ও ইসলামী ব্যাংক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকায় সরকারের দিক থেকে ব্যাংক দুটিকে তা অব্যাহত রাখতে দেয়া ঠিক হচ্ছিল না। তাই এ পরিবর্তন হয়েছে। পাশাপাশি এবি ব্যাংকের বিরুদ্ধে অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। ভবিষ্যতে কোনো ধরনের অনিয়মের আগেই লাগাম টেনে ধরা উচিত বলে তিনি মনে করেন।ভোরেরকাগজ।
আপনার মতামত লিখুন :