মহসিন কবির: রাজধানী ঢাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটছেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, বস্তি, গুদাম বাদ যাচ্ছে না কিছুই। আগুন লাগার কারণ জানতে কমিটি গঠন হয়। দেওয়া রিপোর্ট, কিন্তু আগুন থেকে বাঁচার সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না।
সবশেষ শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) লাগলো রাজধানীর হাজারীবাগ কাঁচাবাজারের কাছে একটি ট্যানারি গুদামে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। আজ শুক্রবার বেলা পৌনে ৩টার দিকে ওই গুদামে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ডিউটি অফিসার লিমা খানম।
আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
জনপ্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৫ডিসেম্বর রাতে। আগুনে ৭ নম্বর ভবনের চারটি ফ্লোরে একাধিক মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি ও আসবাব পুড়ে গেছে। শুরু থেকে আগুনের নেপথ্যে ‘নাশকতা’ সন্দেহ করা হলেও ‘দুর্বল বিদ্যুৎ সংযোগ’র কথা বলা হয়েছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে।
শুধু সচিবালয় নয়, ডিসেম্বরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিট এশিয়া লিমিটেড কারখানার গুদামে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছে। একই মাসে শ্রীপুরে বোতাম তৈরির কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যায় তিনজন। থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে গিয়ে আতশবাজি ও ফানুস থেকে আগুন লেগে শিশুসহ ৫ জন দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছে। এমন একটি বা দুটি নয়, শীত শুরুর পর রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ভয়াবহভাবে বেড়েছে অগ্নিদুর্ঘটনা।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৪ হাজার ৪৭৮টি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে দুই হাজারের বেশি আগুন লেগেছে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জুন-এই ৭ মাসে অগ্নিদুর্ঘটনা বেশি ঘটে। সব থেকে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও জুন মাসে। আবার সব থেকে কম আগুনের ঘটনা জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই পাঁচ মাসে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৭ মাসে ৫২ হাজার ৭৫৩টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে ৫ মাসে আগুনের ঘটনা ছিল ২০ হাজার ৫৩৪টি। বছরভিত্তিক হিসাবে, প্রতিবছর কমপক্ষে তিন হাজারের বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা বাড়ছে। শীতের সময়সহ মাত্র ৪ মাস সতর্ক থাকলে অগ্নিদুর্ঘটনা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ২৭ হাজার ৬২৪টি। ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি। ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি। ২০২০ সালে ২১ হাজার ৭৩টি। ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি ও ২০১৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ৬৪২টি।
অন্যদিকে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ২৪ হাজার ৪৭৮টি। গড়ে প্রতি মাসে ২ হাজারের বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। ডিসেম্বর মাসের প্রকৃত হিসাব যোগ হলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। তথ্যে দেখা গেছে, ২১ সালের পর প্রতিবছর তিন হাজারের বেশি দুর্ঘটনা বেড়েছে। মাসভিত্তিক হিসাবে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে ২৩৭২টি। ফেব্রুয়ারিতে ৩০০০, মার্চে ৩৫১৯, এপ্রিলে ৩৪২৭, মে’তে ৩৬১১, জুনে ১৯৪৭, জুলাইয়ে ১৩৭৬, আগস্টে ১৮৯৭, সেপ্টেম্বরে ১২৯১, অক্টোবরে ১১৮৯ ও নভেম্বরে ১৩৮৯টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত আগুনের ঘটনা বেশি। আর জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ কমে আসে।
২০২০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩ বছরের তথ্যে দেখা যায়, ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৭ মাসে আগুন লাগে ৫২ হাজার ৭৫৩টি। যেখানে একই সময়ে ৫ মাসে আগুনের ঘটনা অর্ধেকেরও কম অর্থাৎ ২০ হাজার ৫৩৪টি। ২০২৩ সালে সব থেকে বেশি আগুন লাগে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে।
এদিকে, ২০০৪ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত বড় অগ্নিকাণ্ড ও বেশি সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে এমন ৩০টির মতো ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব থেকে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছিল মার্চ মাসে ৮টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮টি ঘটেছে ফেব্রুয়ারিতে। এছাড়া এপ্রিলে ৫টি ও জুনে ৪টি ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার বলেন, সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ৭ মাসে বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও জুনে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি। তিনি বলেন, শীতকালে সব ধরনের দাহ্য বস্তু শুকিয়ে যায়। এ প্রাকৃতিক শুষ্কতা আগুন লাগার পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়া শীতের সময়ে চুলা জ্বালিয়ে রাখা, লাকড়ি জ্বালিয়ে আগুন পোহানো, বেশি ধূমপান করাসহ নানা কারণে আগুন বেশি লাগে। ফলে শীতসহ অন্তত ৪ মাস অধিক সতর্ক ও সাবধান থাকলে আগুনের ঘটনা অর্ধেকের বেশি কমে আসবে। এক্ষেত্রে শীতের আগে আগে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দেশের সব মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের সতর্কতামূলক বার্তা পাঠানো হয়ে থাকে।
ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট তথ্যে দেখা গেছে, ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন একাধিক অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে বেশ কয়েকটিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ২৫ ডিসেম্বর রাতে সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৭ নম্বর ভবনের ৬ তলা থেকে ৯ তলা পর্যন্ত চারটি ফ্লোরের ২০০টি কক্ষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর আগে ২২ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুরে এম এন্ড ইউ ট্রিমস লিমিটেড নামের বোতাম কারখানায় আগুনে এখন পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ২১ ডিসেম্বর বনানী বস্তিতে ভয়াবহ আগুন লাগে।
২০ ডিসেম্বর উত্তরার লাভলীন বাংলা রেস্টুরেন্টে আগুন লেগে বেশ কয়েকজন আহত হন। একইদিন নাটোরের বড়াইগ্রামে আগুনে পুড়ে আলিজা খাতুন নামের ৯ মাস বয়সি এক শিশুর মৃত্যু হয়। ১৯ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জে আলী আহমদ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে। ১৮ ডিসেম্বর মহাখালীর কড়াইল আদর্শনগর বস্তিতে আগুন লাগে। ১৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে জাহিন স্পিনিং মিলে ভয়াবহ আগুন লাগে। ১১ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরে গ্রিন লিফ নামের ফিলিং স্টেশনে গ্যাস রিফিলের সময় বাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৫ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২৪ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরে একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লেগে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয়।
আপনার মতামত লিখুন :